‘আবদুল্লাহ মজুমদারের দুধের বালক
স্নিগ্ধ – নবনীত আবেশ – আবহ
* আবু মুসা চৌধুরী *
সাহিত্যের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও নান্দনিক মাধ্যম কবিতার রুপতত্ত্ব- শিল্পশৈলী জটিলতা ও ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। এ কারণে কী কবিতা, কেন কবিতা, কোথায় কবিতা, কীভাবে কবিতা- তা নিয়ে বাগাড়ম্বর ব্যাখ্যা ও তর্কের অন্ত নেই। কিন্তু প্রকারান্তরে এতদ্ বিষয় মানে কবিতা প্রসঙ্গে আলোচন – পর্যালোচনা শেষতক ডগমা (Dogma) বা কূটতর্ক এবং অমীমাংসায় পর্যবসিত হয়।
বিষয়টা ওঠে এলো এ কারণে যে, আবদুল্লাহ মজুমদার রচিত ১ম কাব্য দুধের বালক আদ্যোপান্ত পাঠ- পরবর্তী উপলব্ধিজাত আন্তর মিথস্ক্রিয়া। ‘দুধের বালক’ নামের মধ্যেই এক ধরণের নরম নবনীত তরতাজা কোমল – স্নিগ্ধ আবেশ – আবহ। এই কাব্যের ফ্ল্যাপের গদ্যে লেখা হয়েছে, ‘এক ধরনের সারল্যের উচ্চারণ, অন্তরাত্মার আর্তি ও আর্তনাদের মূর্চ্ছণায় আকীর্ণ নির্মিতিতে। আবদুল্লাহ মজুমদারের প্রথম গ্রন্থনায় অমেয় সম্ভাবনা ও আলোকোজ্জ্বল আগামী দিনের ঝিলিক। আশা ও আকাঙ্খার পিদিম জ্বলতেই থাকে দুর্নিবার। প্রেম- বিরহ, প্রাপ্তি – অপ্রাপ্তি -সময় -মড়ক – মহামারি ও পারিপার্শ্বের সংবেদী সুষমায় শিল্পিত সরণি বেয়ে হেঁটে হেঁটে যান আবদুল্লাহ। তার এই অনিবার ও অনিঃশেষ যাত্রা নিশ্চয়ই একদিন স্বপ্নের সুবর্ণ বন্দরে নোঙর ফেলবে। এই প্রতিশ্রুতির সজ্জা বা উপকরণের আয়োজন গ্রন্থের সমুদয় পরতে। ‘
কবিতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক- আবদুল্লাহ মজুমদার এক অবোধ বালকের সহজ – সরল -অজটিল মুগ্ধতা ও তৃষিত চোখ ও অনুভব নিয়ে তার পারিপার্শ্ব নিরীক্ষা করেন। তার নজরদারীতে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। আছে এক দুগ্ধপোষ্য বালকের বিস্ময়। তার দৃষ্টিপাত এসে পড়ে ‘কৃষ্টি কালচার’, ভালোবাসার স্থাপত্য, রূপ, ক্লিনিক্যাল বায়োগ্রাফি ‘ ব্যস্ত নগরীর স্বপন, রুগ্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা, করোনাকাল আরো বিবিধ উপাচারে।
এইসব বিষয়- বিশ্লিষ্ট হয়ে রচনার অন্তিম মোচড়ে একটা ম্যাসেজ, শুভবোধ আবার কখনো একটা স্যাটায়ার ঝলসে ওঠে। দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক-
কোনো বিনিময় দিতে পারবো না
নিঃস্বার্থ এই ত্যাগের
শরীরের সাথে খারাপ থাকে যদি
অবস্থা মানিব্যাগের।
অসুস্থ মানিব্যাগের কাছে হেরে যায়
সুস্থ বিবে!
(পরাভব)
কিংবা-
উর্বর সাহিত্য কবিতার চাষাবাদ
জটিল ও জটিলতর।
পাঠকের মন-মস্তিষ্কের স্নায়ুচাপ
কী আসে কবির!
কবি মানে সাহিত্যের পুরোহিত
কবি মানে যৌনশিল্পের চাষি
(যৌনশিল্প)
তো, এরকম স্পষ্টতা – ভাব প্রকাশের সরাসরি নির্মিতিতে রয়েছে সমূহ ঝুঁকি। কেননা ইচ্ছেপূরণের অভিপ্রায় বা নিরলঙ্কার শৈলীতে কবিতা ঝুলে পড়ার কিংবা জোলো হওয়ার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক। সুদক্ষ কবজীর মোচড় ব্যতিরেকে এই বেড়াজাল উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন ও শ্রমসাধ্য। আবদুল্লাহ মজুমদার নিশ্চয়ই নিরন্তর চর্চায় ও ভালোবাসায় এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারবেন।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। কবিতা পদ্য ও ছড়া এই তিন সাহিত্যমাধ্যমের রয়েছে স্বতন্ত্র ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও কৃতকৌশল। নির্মিতিতে ‘শব্দও আলাদা। যেহেতু আবদুল্লাহ মজুমদার একজন ছড়াশিল্পী, তাই তার রচনায় ইতিউতি শব্দে-ছন্দে- আঙ্গিকে ‘ছড়ামো’ আসাটাই স্বাভাবিক। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায় দুধের বালক গ্রন্থে আবদুল্লাহ বেশ ক’টি শিল্পসমৃদ্ধ – সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ ছড়া রচনা করেছেন।
যেহেতু এটি তার প্রথম গ্রন্থ, তাই যাবতীয় সীমাবদ্ধতা -ঊনতা ছাড়িয়ে – ছাপিয়ে কিছু কিছু কবিতার উজ্জ্বল পঙক্তি ঝিকিয়ে ওঠে। পরবর্তী কাজে আবদুল্লাহ মজুমদার নিশ্চয়ই আরো আরো পরিণত কবিতা নিবেদন করবেন।
সুহৃদ পাঠকদের উদ্দেশে আবদুল্লাহ মজুমদারের একটি কবিতা উপস্থাপন করলাম–
যদি কোনোদিন তোমায় ছুঁয়ে দিই
কষ্ট পাবে?
যেভাবে ছুঁয়েছি তোমার পরাণ
কবিতার পান্ডুলিপি!
যদি কোনোদিন স্বপ্নে তোমার
ভালোলাগার স্পর্শ পাই
তুমিও সুখি হবে।
স্বপ্নে তোমাকে তাই —
একটুখানি ছুঁয়ে দিতে চাই
( ছোঁয়া)
দুধের বালক – আবদুল্লাহ মজুমদার। প্রচ্ছদ : রোজিনা আফরোজ লিপি। প্রকাশক : লাবীবা প্রকাশন। মূল্য : ১২৩ টাকা।
* আবু মুসা চৌধুরী
কবি ও সাহিত্য সমালোচক