ওচমান জাহাঙ্গীর;চট্টগ্রামচট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার কোরবানির পশু সংখ্যা ৯ লাখ ছুঁই ছুঁই করতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। কিন্তু সেই অনুপাতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে লক্ষ্য রাখা হয়নি—আড়তদারদের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র সাড়ে চার লাখ পিস। প্রতিবছরই এই বিভ্রাট যেন এক চেনা চিত্র হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার বাজারে।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামে বিগত বছরগুলোতে গড়ে তিন থেকে চার লাখ কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন তারা এবং অন্যান্য খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীরা। গত বছর কোরবানির দিনেই চট্টগ্রামে সংগৃহীত চামড়ার সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ, যা পরবর্তীতে গিয়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৬১ হাজার পিসে।
সমিতির আহ্বায়ক আবদুল জলিল বলেন, “জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ প্রতি বছর যে সংখ্যক কোরবানির পশুর পূর্বাভাস দেয়, বাস্তবে আমরা ততটা চামড়া পাই না। তারা কীভাবে হিসাব করে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করি, তারা জানি – চট্টগ্রামে সাধারণত তিন থেকে চার লাখ চামড়াই সংগ্রহ হয়।”
তিনি আরও জানান, পতেঙ্গা, আগ্রাবাদ, বিবিরহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি – এই অঞ্চলগুলো ঘুরে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন আড়তদারেরা। চলতি বছর এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের মতো শিল্পসমৃদ্ধ শহরে এখন মাত্র একটি সক্রিয় ট্যানারি—রিফ লেদার লিমিটেড। একসময় চট্টগ্রামে যেখানে ৩০টির বেশি ট্যানারি ছিল, বর্তমানে শুধুমাত্র একটি ট্যানারিই চট্টগ্রামের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করছে, তাও কেবল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পরিমাণ।
চট্টগ্রামের আড়তদাররা রিফ লেদার বাদে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখানেই তৈরি হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী সংকট। ঢাকার প্রায় ১৭০টি ট্যানারি চট্টগ্রামের চামড়া বাকিতে নিয়ে থাকলেও, অনেকেই বছরের পর বছর টাকার কোনো হিসাব দেন না।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “২০১৫ সাল থেকে ট্যানারি মালিকরা সময় মতো টাকা পরিশোধ না করায় অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা যারা এখনও ব্যবসা করছি, তারাও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।”
সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের সর্দার জানান, “একসময় এ ব্যবসায় চট্টগ্রামে ২৫০-৩০০ জন আড়তদার ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা কমে এসেছে ২৫-৩০ জনে। বাকিরা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “ট্যানারিরা শুধু একটি কাগজের স্লিপ দেয়। এতে কোনো আইনি ভিত্তি থাকে না, ফলে টাকা না পেলে আমরা কিছুই করতে পারি না। মৌখিক লেনদেনের এই প্রথা বন্ধ না হলে, চামড়া ব্যবসা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে।”
প্রতি বছর কোরবানির আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে কাঁচা চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়। গত বছর চট্টগ্রামে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০–৫৫ টাকা। অথচ আড়তদারেরা জানান, তারা গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট কিনেন ৩০–৩৫ টাকায়।
আড়তদার সমিতির মতে, গুদাম ভাড়া, লবণ, শ্রমিক মজুরি, পরিবহন খরচ – সব মিলে প্রতি পিস চামড়া প্রক্রিয়াকরণে বড় অঙ্কের ব্যয় হয়। এর পরও ট্যানারি মালিকরা অনেক চামড়া বাদ দিয়ে দেয়। ফলে আড়তদারেরা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হন—একদিকে ক্রয়মূল্য না ওঠা, অন্যদিকে বিক্রয়মূল্য না পাওয়া।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, “চট্টগ্রামে ট্যানারি স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ এখানে সহজলভ্য শ্রমিক, কাঁচামাল ও পরিবহনব্যবস্থা থাকায় ট্যানারি শিল্প গড়ে উঠলে হাজারো কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারত।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার যদি এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার বিশাল সম্ভাবনাময় শিল্পটি একসময় বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।”