২০১৫ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি গোলাম জিলানীর উদ্যোগে গঠিত হয় “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদ”। এরপর ২০১৮ সালে ব্যবসায়ী নেতা মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে এর সমান্তরালে গড়ে ওঠে “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন”—যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি পায়।
দুই সংগঠনই তাদের নিজ নিজ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে, যদিও ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রভাব বিস্তার ছিল স্পষ্ট। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, দেশে সংঘটিত রাজনৈতিক ‘বিপ্লব’-পরবর্তী সময়ে মাহবুবুল আলম আকস্মিকভাবে দেশত্যাগ করেন এবং তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখান থেকেই এলামনাই রাজনীতিতে শুরু হয় নতুন হিসাব-নিকাশ, যা সময়ের সঙ্গে রূপ নেয় তীব্র বিভাজনে
ওচমান জাহাঙ্গীর:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন চবি এলামনাই এসোসিয়েশন এখন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রস্থলে। একসময় প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত এই সংগঠনটি এখন বিভক্ত, বিভ্রান্ত ও বিতর্কিত। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এর নেতৃত্বে বড় ফাটল সৃষ্টি করেছে—যেখানে দুইটি গ্রুপ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, মামলাবাজি ও দখল রাজনীতিতে লিপ্ত।
এই বিভাজনের একপাশে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আসলাম চৌধুরী, অন্যপাশে রয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও চবির সাবেক ভিপি এস এম ফজলুল হক ফজু। উভয় পক্ষই নিজেদের নেতৃত্ব বৈধ বলে দাবি করছেন এবং একে অপরকে বৈধতা ও নৈতিকতা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন। ফলে চবি এলামনাই একটি আদর্শিক ও সাংগঠনিক দ্বন্দ্বের নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।
এলামনাই’র দ্বৈত জন্ম ও বিভক্ত পথচলা
২০১৫ সালের শেষ দিকে চবি ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক জিএস গোলাম জিলানীর উদ্যোগে গঠিত হয় “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদ”। এরপর ২০১৮ সালে ব্যবসায়ী নেতা মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে এর সমান্তরালে গড়ে ওঠে “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন”—যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিতি পায়।
দুই সংগঠনই নিজেদের কর্মসূচি চালিয়ে গেলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক ‘বিপ্লব’-পরবর্তী সময় মাহবুবুল আলম দেশত্যাগ করেন এবং তার সংগঠন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখানেই ঘটে নাটকীয় মোড়।
গোলাম জিলানীর ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন ছাত্রনেতারাই তখন মাহবুবুল আলমের পরিত্যক্ত সংগঠনের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে এটিকে বিএনপি ঘনিষ্ঠ নতুন বলয়ের মাধ্যমে সক্রিয় করে তোলেন। এখান থেকেই উত্থান ঘটে দুটি গ্রুপের—আসলাম চৌধুরী ও ফজলুল হক ফজুর নেতৃত্বাধীন অংশের।
মামলা, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তির লড়াই
বর্তমানে এই সংগঠনে দুটি পৃথক কমিটি সক্রিয় রয়েছে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টা সভা, বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং মামলার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। এতে শুধু সংগঠনটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, প্রাক্তন সদস্যদের মাঝেও তীব্র হতাশা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এই বিভাজন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে কেউ কারও বৈধতা স্বীকার করছেন না। চবি এলামনাই আর কোনো মিলনমেলা নয়, এটি এখন একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ময়দান।
চার কোটি টাকার আত্মসাৎ ও নেতৃত্বের অনুপস্থিতি
এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, তিনি সদস্যদের অনুদান ও প্রকল্পভিত্তিক অর্থ সংগ্রহ করে তার কোনো হিসাব দেননি এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার পর নিরাপদে বিদেশে চলে গেছেন।
তার ঘনিষ্ঠরা বলছেন, তিনি ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ বিদেশে অবস্থান করছেন এবং এ বিষয়ে শিগগির ব্যাখ্যা দেবেন। তবে সংগঠনের বর্তমান সক্রিয় অংশ এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় এবং স্বচ্ছ নিরীক্ষা ও আইনি ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার।
প্রতিচ্ছবি মাত্র: বড় রাজনীতির প্রতিধ্বনি
চবি এলামনাই’র এই দ্বন্দ্ব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র সংস্করণ। নেতৃত্বের স্বচ্ছতা, সাংগঠনিক জবাবদিহিতা, এবং আদর্শগত দায়বদ্ধতা না থাকলে কিভাবে একটি সম্ভাবনাময় সংগঠন রাজনীতির বলি হয়—এই সংগঠন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এই ঘটনা আমাদের শেখায়, কেবল পদ-পদবির জন্য সংগঠনের নেতৃত্ব দখলের সংস্কৃতি এক ভয়াবহ প্রবণতা। এখানে আদর্শ, মূল্যবোধ বা প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণ—এসব হারিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ছায়ায়।
চবি এলামনাই আজ আর শুধুই প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন নয়; এটি এখন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীকী যুদ্ধক্ষেত্র। তাই এই সংগঠনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এ প্রশ্নের জবাবের ওপর—তারা কি নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে পারবে, নাকি চিরস্থায়ী রাজনৈতিক বিভাজনের বলি হয়ে ইতিহাসে হারিয়ে যাবে?
[সাবেক চবিয়ান ও গবেষক]