ফয়সাল আহমেদ শান্ত—এই নামটি এখন আর জীবন্ত একজন তরুণের পরিচয় নয়, বরং একটি পরিবারের বেদনাময় স্মৃতি। চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ওমরগণি এমইসি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শান্ত। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।
গত ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) চট্টগ্রামের মুরাদপুর ২ নম্বর গেট এলাকায় আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরদিন সকালে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হয় বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মহিষাদী গ্রামে। সেখানে স্বজনদের আহাজারিতে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা এলাকা। জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ শান্তকে।
শান্তর বাবা জাকির হোসেন পেশায় পুরনো জাহাজের আসবাবপত্র ব্যবসায়ী। মা কহিনুর আক্তার একজন স্কুলশিক্ষিকা। পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামের ইপিজেডে বাস করতেন শান্ত। ছোটবোন সুমাইয়া জান্নাত বৃষ্টি এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না—তার ভাই আর নেই। সে বারবার বাবাকে বলছে, “আব্বু, আমার ভাইয়ারে ফিরায়া দাও।”
আন্দোলন থেকে শহীদ হওয়ার ইতিহাস
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৫ জুলাই আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে প্রথমে সংঘর্ষ শুরু হলে পরে তাতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরাও যুক্ত হয়। ১৬ জুলাই বিকেলে শান্তকে সামনের সারিতে দেখা যায়, যখন ছাত্রলীগের কয়েকজন অস্ত্রধারী প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়ছিল। সেখানেই তিনটি গুলিতে লুটিয়ে পড়েন শান্ত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রামের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অস্ত্রধারীরা যুবলীগের নেতাকর্মী, যারা নগর আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী বলে পরিচিত।
শোকাহত পরিবার ও প্রতিবেশীদের অভিব্যক্তি
শান্তর বাবা বলেন, “আমার ছেলে তো অধিকার চাইতে গিয়েছিল। সেই অধিকারের বদলে তাকে গুলি উপহার দেওয়া হলো কেন?” চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, “আমি শহীদ ফয়সালের গর্বিত পিতা—এটাই এখন আমার পরিচয়।”
মা কহিনুর আক্তার বলেন, “আমি তো ভেবেছিলাম ছেলে আমার অ্যাওয়ার্ড এনে দেবে, আমি হবো সেরা মা। সে সত্যিই আমাকে সেরা মায়ের সম্মান দিয়ে গেল। আজ আমি শহীদের মা—এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।”
শান্তর প্রতিবেশী আলাউদ্দিন বলেন, “শান্ত ছিল সত্যিকার অর্থেই শান্ত। কখনও ঝগড়া করত না। তার মতো ছেলেকে কেউ গুলি করে মেরে ফেলবে, তা কল্পনাও করিনি।”
বন্ধুরা যা বলছে
ঘটনার সময় পাশে থাকা বন্ধু সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “আমরা তিনজনই মুরাদপুরে আন্দোলনে গিয়েছিলাম। ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা আমাদের ধাওয়া দেয়। শান্ত তখন একদম সামনে ছিল। হঠাৎ পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া শুরু হলে একটি গুলি শান্তর বাম পাশে লাগে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শান্তকে আর বাঁচানো যায়নি।”
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন বলেন, “গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শান্তকে হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।”
ফয়সাল আহমেদ শান্ত শুধু এক তরুণের নাম নয়—তিনি এই সময়ের ছাত্রজনতার অধিকার ও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।