চট্টগ্রাম ব্যুরো
জাল শিক্ষাগত সনদ ব্যবহার করে দেশের চারটি শীর্ষ ব্যাংকে দুই দশক চাকরি করেছেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (৫২)। ব্যাংক থেকে কোটি টাকার বেতন–ভাতা তোলার পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদও দখল করেছিলেন। অবশেষে প্রতারণার এই কাহিনি ফাঁস হয়ে যায়। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) জাল সনদের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে স্কুল সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়।
একই দিনে এক কলেজে ফেল, অন্য কলেজে ‘পাস’!
জাহাঙ্গীর আলমের দেওয়া তথ্যমতে তিনি পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বারইয়ারহাট কলেজ থেকে এইচএসসি, ওমর গণি এমইএস কলেজ থেকে বিএ (পাস) এবং ইউএসটিসি থেকে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ পাস করেছেন।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে তিনি পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। অথচ একই দিনের আরেকটি সনদে দেখা যায়, মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট কলেজ থেকে তিনি ‘পাস’ করেছেন। শিক্ষা বোর্ডের ট্যাবুলেশন শিট বিশ্লেষণেও দেখা গেছে—১৯৯৬ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি পটিয়া কলেজে ফেল করলেও কথিত বারইয়ারহাট কলেজের মার্কশিটে পাস দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে ইউএসটিসি থেকে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ ডিগ্রির দাবিও ভুয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, সেখানে এ নামে কোনো কোর্সই নেই।
ব্যাংকিং ক্যারিয়ার ও কোটি টাকার বেতন-ভাতা
২০০৩ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ক্যাশ অফিসার হিসেবে ব্যাংকিং খাতের ক্যারিয়ার শুরু করেন জাহাঙ্গীর। এরপর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এবং সর্বশেষ আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে যোগ দেন।
ধাপে ধাপে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) এবং সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) পদে উন্নীত হন তিনি। ব্যাংক নির্বাহীদের হিসাবে, চারটি ব্যাংক থেকে তিনি ২০ বছরে আনুমানিক ৩.৫ কোটি টাকার বেশি বেতন–ভাতা তুলেছেন।
তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জাল সনদ ধরা পড়লে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
শিক্ষা বোর্ড ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ জানান, “অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় জাহাঙ্গীরকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান বলেন, “বোর্ডের চিঠি হাতে পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রতারক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে তার জাল সনদের ভিত্তিতে দুই দশক ধরে চাকরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের তদন্তের দাবি উঠেছে।
রাজনৈতিক সংযোগ ও মধ্যস্থতার অভিযোগ
জাহাঙ্গীর আলম শুধু ব্যাংকার ছিলেন না, তিনি দীর্ঘদিন বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) হিসেবে কাজ করেছেন।
সরকার পরিবর্তনের পর গত বছরের আগস্ট থেকে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাকে বৈঠক করতে দেখা গেছে। একটি সূত্র জানায়, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের পক্ষ হয়ে তিনি সম্পদ রক্ষায় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন।
মাস খানেক আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বোট ক্লাবে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। ওই বৈঠকে সাতকানিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা জসীম উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন।
গত রমজানেও মক্কায় জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে জানা যায়। ওই সময় সেখানে অবস্থান করছিলেন সাইফুল আলম মাসুদও।