আমরা অজ্ঞ বেকুব লোকদেরকে মুষল বলে গালি দিই।মুষল’ হলো ঢেঁকির মাথার অংশ; আর ‘ধারা’ মানে প্রবল বর্ষণ। ঢেঁকির এক দিকে পা দিয়ে পাড়া দেওয়া হয়। অন্য মাথায় প্রায় চার ফুট আকারের ভারী দণ্ড বা মুগুর থাকে। এই দণ্ডকে বলে মুষল।
বউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পার দিয়া , আমি নাচি ঢেঁকি নাচে হেলিয়া দুলিয়া । ” গ্রামাঞ্চলে ঢেঁকিতে ধান ভানার সময় এমন গানটি প্রায়ই শুনি যেত । ঢেঁকি প্রধানত ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বানানো কাঠের তৈরি কল বিশেষ । গ্রামাঞ্চলে চাল ও অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক । সাধারণত ঢেঁকিতে প্রায় ছয় ফুট লম্বা এবং ছয় ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট একটি কাঠের ধর থাকে । মেঝে থেকে প্রায় ১৮ ইঞ্চি উচ্চতায় ধরের একেবারে সামনে ২ ফুট লম্বা একটি গোল কাঠ যাকে মোনা বলা হয় ও দুটি খুঁটির ভিতর দিয়ে একটি ছোট হুড়কা থাকে । এই হুড়কার উপরই ধড়টি ওঠানামা করে । ঢেঁকি পা হাতের দ্বারা চালিত গ্রামীণ যন্ত্র বিশেষ । এর দ্বারা ধান ভেনে চাল বানানো হয় । প্রয়োজনে চাল থেকে গুঁড়া বানানো হয় । ফসলের সঙ্গে ঢেঁকির সম্পর্ক দিয়ে সূচিত হয়েছিল প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস । ঢেঁকির সঙ্গে নারীর সম্পর্ক নিবিড় । কারণ ঢেঁকি পরিচালনা করে নারীরা । এটি চালানোর জন্য সাধারণত তিনজন নারীর অংশ গ্রহণ প্রয়োজন হয় । দুজনে খানিকটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে পা দিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দেয় । অন্যজন মাটিতে বসে মুষলের নীচে ধান বা চাল ওলোট পালট করে দেয় । যাতে ধানের খোলস ভেঙে চাল বেরিয়ে আসে । বাংলাদেশের অনেক গ্রামে এমন সংস্কার বা রীতি প্রচলিত ছিল যে , নতুন ধান প্রথমে মেশিনে না ভাঙিয়ে ঢেঁকিতে ভানা হত । এর পরে সমস্ত ধান চাল করার জন্য মেশিনে নিয়ে যাওয়া হত । এক সময় বাংলার গ্রামগুলো নতুন ফসল তোলার পরে ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো । প্রতিটি গৃহাস্ত বাড়িতে ঢেঁকি ঘর থাকত । ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানভানে , বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধরে প্রচলিত হয়ে এলেও ঢেঁকি এখন আর ধানভানে না । জন্ম থেকে মৃত্যুর ব্যবধানে প্রতিটি মানুষ প্রতিটি কাজ খুব দ্রুত সমাধানের জন্য সাহায্য নিচ্ছে যন্ত্রের । আর এ কারণেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের তালিকা থেকে ঢেঁকি ক্রমান্বয়ে বাদ পরে যাচ্ছে । যান্ত্রিক যুগের কলাকৌশলে ঢেঁকির অস্তিত্ব আজ বিলীন । এ উপমহাদেশের অনেক জাদুঘরে এখন ঢেঁকি দেখতে পাওয়া যায় । অগ্রহায়ণ মাসে ঢেঁকিতে নতুন ধান ভেঙে চাল করার ধুম পড়ে যেতো ঘরে ঘরে । ঢেঁকির ধুম ধুম শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোমর দুলিয়ে ঢেঁকিতে পা দিয়ে পাড় দিতো বাড়ীর মহিলারা । মধ্যরাত থেকে ভোররাত জেগে ধান ভানার মধ্যে বাংলার গৃহবধূরা কোথায় যেন একটা সুখের সন্ধান খুঁজে পেত । সর্বোপরি বলতে গেলে ঢেঁকি আজ যেন রূপকথার গল্পের মত হয়ে গেছে । অন্যদিকে কোথাও কোথাও আবার প্রদর্শনীর জন্য ঢেঁকিকে নিয়ে এসেছে শহরে , শোভা পাচ্ছে শোকেসে । কালের প্রভাবে ঢেঁকির ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা বিলুপ্ত হয়ে বিকল্প ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে । “ ও ধান ভানরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া , মিম নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া । ও ধান ভানরে ধান বেচিয়া কিনমু শাড়ী পিন্দা যাইমু বাপর বাড়ী , স্বামী যাইয়া লইয়া আইব গারুর গাড়ী দিয়া । ও ধান ভানরে ” । চিরায়ত বাংলার এই গান বাঙালীর ঢেঁকির আবহ জানান দেয় । নতুন ধান বানা , সেই ঢেঁকিতে ছাঁটা নতুন চালে পিঠার গুড়ি । আবার ঢেঁকিতে চিড়া কোটা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের অংশ জুড়েই আছে । প্রবচনেও একদা শোনা যেত “ চিরা কুটি , বারা বানি , হতিনে করইন কানাকানি । জামাই আইলে ধরইন বেশ , হড়ির জ্বালায় পরান শেষ ” । গ্রাম্য নারীদের সেই আনন্দের গান এখন আর শোনা যায়না । ষাট বা সত্তরের দশকে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরেই ঢেঁকি ছিল সংসারের অপরিহার্য একটি উপাদান । ঢেঁকি ছিলনা এমন বাড়ী বা এমন সংসার ছিলনা বললেই চলে । কৃষক মাঠ থেকে ধান কেটে আনতো । সেই ধান মাড়িয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে পাহার দিয়ে চাল বানানো হতো । তারপর সেই চালে রান্না হতো । তখন চাল ভাঙ্গানো এমন মেশিন ছিলনা বললেই চলে।ঢেঁকি ছিল প্রত্যেক সংসারের চলমান কার্যক্রমের অপরিহার্য একটি উপাদান ।
চিরচেনা ঢেঁকি আজ কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে গেছে । বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এখন পুরোপুরি যান্ত্রিক ঢেউ লেগেছে । মাছে ভাতে বাংঙ্গালীর ঘরে এক সময় নবান্নের উৎসব হতো ঘটা করে । উৎসবের প্রতিপাদ্যটাই ছিল মাটির গন্ধ মাখা ধান । ঢেকি ছাটা ধানের চালের ভাত আর সুস্বাদু পিঠার আয়োজন । রাতের পর রাত জেগে শরীরটাকে ঘামে ভিজিয়ে ঢেকিতে ধান ভানার পর প্রাণখোলা হাসি । ঢেঁকি একটি কাঠের খন্ড । সাধারনতা বাবরা , গাব বা বেলগাছ দিয়ে ঢেঁকি বানানো হতো । সাধারনত : ছয় বা সাত হাত লম্বা , এক হাত বা তার কিছু কম চেওড়া একখন্ড গাছকে ঢেঁকি হিসাবে ব্যবহার করা হতো । সেই গাছ খন্ডের এক হাত বা তার চেয়ে কিছ বেশী অংশে ছিদ্র করে বসানো একটি কাঠের লম্বা টুকরা , যার নাম মোনাই বা চুরনী । মোনাইয়ের মাথায় বসানো হতো লোহার একটি গোলাকার পাত , যার নাম ছিল গুলো । ধান রাখার জন্য গোলাকার ভাবে মাটি খুড়ে তৈরী হতো একটি গর্ত । যার নাম ছিল নোট । নোটের নিচের অংশে বসানো হতো একটুকরা গাছের গোড়া , যাকে বলা হতো গইড়া । কেউ কেউ আবার কাঠের পরিবর্তে ব্যবহার করতো শীল বা পাথর । ঢেঁকির শেষ অংশে দেড় হাত বাদ দিয়ে আরো এক বা দুইখন্ড কাঠ বসানো হতো খাড়া করে , যার নাম কাতলা । ঢেঁকিতে আড়াআড়ি ছিদ্র করে তার ভিতর ঢোকানো হতো একখন্ড কাঠ , যাকে বলা হতো গোঁজা বা আইসস্যাল । সেই গোঁজা বসানো হতো কাতলার উপর । পিছনে মাটি উচুঁ করে বানানো একটি গোদা । সেই গোদার উপর দাড়িয়ে ঢেঁকিতে পা দিয়ে চাপ দিলে ঢেঁকি উপরে উঠে সজোরে নিচে নামতো । ঢেঁকি সাধারনত বসানো হতো রান্নাঘরে । তখনকার দিনে রান্নাঘর বলে কিছুই ছিলনা । এই ঘরটি পরিচিত ছিল ঢেঁকিঘর নামে । শুকনা ধান নোটের মধ্যে দিয়ে গোঁদার উপর দাড়িয়ে পিছনের অংশে চাপ দিলেই ঢেঁকি উপরে উঠতো এবং পা সরিয়ে নিলেই মোনাই বা চুরনী সজোরে নোটের ভিতর রাখা ধানের উপর পড়তো । এভাবেই ধানের খোসা ছাড়িয়ে বানানো হতো চাল । এভাবেই চাল ,
ডাল , আটা বানানো হতো । পিঠাপুলি বানানোর জন্য চাল গুঁড়া করা হতো এই ঢেঁকির সাহায্যে । গম , যব , বা ভুট্টা গুড়ো করে আটা বানানো হতো । কলাই ভেঙ্গে বানানো হতো ডাল । বিয়ের জন্য হলুদ কোটায় ব্যবহার হতো এই ঢেঁকি । মেয়েরা হলুদ নিয়ে ঢেঁকির নোটের মধ্যে দিয়ে হলুদ কুটি , মিন্দি … বলে সুর করে গান গাইতো আর কনের জন্য হলুদ কুটতো । সেই হুলুদ মেখে কনেকে গোসল করানো হতো । বিয়ের সাজে সাজতো নারী । সেই দিন ছিল একটি আনন্দের । ঢেঁকি ছিল গ্রাম বাংলার একটি উৎসব । দৈনন্দিন সংসারের সব কাজে ঢেঁকি ছিল একটি অপরিহার্য্য উপকরন । এক সময় এ দেশের প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে ঘরে ঘরে ছিল ঢেঁকি । ভোর হতে না হতেই বাংলার নারীরা ঢেঁকি দিয়ে ধান , চাল ও গম ভানতে শুরু করতেন । ঢেঁকির ধাপুর – ধুপুর শব্দ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ত । এভাবেই দিনভর ঢেঁকির ধাপুর – ধুপুর শব্দে মুখরিত থাকত পুরো গ্রাম । ঢেঁকি সাধারণত নারীরাই ব্যবহার করত । ঢেঁকি কমপক্ষে দু’জন নারীকে চালাতে হতো । শীতের দিনে গ্রাম গঞ্জে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যেতো । তাছাড়া বাড়িতে অতিথি আসলে কিংবা অনুষ্ঠান আয়োজন শুরু হলেই পিঠা তৈরির জন্য চাল ভানতে ঢেঁকির ব্যবহার করতে হতো । প্রাচীনকাল থেকে ধান , গম ও চাল ভানতে নারী ও গৃহবধূরা ঢেঁকির ওপরই নির্ভর করত । ঢেঁকি ছাড়া ধান , চাল , গম ভাঙ্গানো ভাবাই যেত না । এভাবেই আশি দশক পর্যন্ত ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছিল । এখন পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট । গ্রাম – গঞ্জের প্রায় প্রতিটি হাট – বাজারে পৌঁছে গেছে বিদ্যুত । গ্রামে শ্যালো ইঞ্জিন কিংবা ধান ভাঙ্গার মেশিনও ছড়িয়ে পড়েছে । ভাসমান মেশিন দিয়েও এখন ধান , চাল , গমসহ নানা জাতীয় খাদ্য সামগ্রী ভাঙ্গানো হচ্ছে । এখন ঢেঁকি দিয়ে কাউকে ধান কিংবা গম ভেঙ্গেছে তা শোনা যাচ্ছে না । আবার কোন কোন এলাকায় ঐহিত্য হিসেবে ঢেঁকি দিয়ে শুধু পিঠার তৈরির জন্য ধান ভানা হয়ে থাকে । এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে ঢেঁকি চিনতে পারবে কিনা তাও সন্দেহ রয়েছে । এখন আমরা বাজারে গিয়ে ধান , চাল , গমসহ নানা উপকরণ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসি । শোনাও যাচ্ছে না নেই সেই ঢেঁকির ধাপুর – ধুপুর শব্দ।ঢেঁকি এখন বিলীন হয়ে গেছে । ঢেঁকি এখন শুধুই কাগজে – কলমে ও স্মৃতির মণি কোঠায় রয়েছে । প্রযুক্তির ছোঁয়ায় , কালের বিবর্তনে এখন হারিয়ে গেছে গ্রাম্য ঐতিহ্য আর সংসারের শোভা সেই চিরচেনা ঢেঁকি । ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো এই ঢেঁকির নাম শুনতেই পাবেনা । ঢেঁকি নামক একটি নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরন গ্রাম বাংলায় ছিল , তা আর কেউ জানতেই পারবেনা । ইতিহাসে বন্দি হয়ে যাবে “ ঢেঁকি ” নামক এই নিত্যব্যবহার্য্য উপকরন । সত্যি কথা বলতে গেলে ঢেঁকির কথা আজ যেনরূপকথার গল্পের মতো করে শোনাতে হয় আমাদের নতুন প্রজন্মকে । আগামী প্রজন্মের কাছে হয়তো এটা স্বপ্নের মত মনে হবে । ঢেঁকি যে এখন জাদুঘরে শোভা পাবে তা সময়ের ব্যাপার । আজ আমরা সকল কিছুতেই আধুনিক । মনটাও হয়ে গেছে যান্ত্রিক । আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক কিন্তু আত্মা বেঁচে থাকুক । আত্মাহীন মানুষ আর কৃষ্টি ভুলে যাওয়া মানুষ সমতুল্য । উল্লেখ্য , ধান ভাঙা ঢেঁকি আমাদের গ্রাম বাংলার প্রাচীন গ্রামীন ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ জিনিস । গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশেও এর একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল।
( সহায়ক গ্রন্থ : পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি , শ্রী বিনয় ঘোষ । )