– মো. কামাল উদ্দিন
সাগরের কোলঘেঁষা সবুজ পাহাড়ের পটভূমিতে গড়ে ওঠা চট্টগ্রামে জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলা এক নিবেদিতপ্রাণ মানুষের নাম—ওসমান জাহাঙ্গীর। তিনি একজন নির্ভীক চারণ সাংবাদিক ও ছবির যাদুকর, যিনি ষাট বছর ধরে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে একনিষ্ঠ সাধনার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন। জীবনের অর্ধপথে তার সহধর্মিণীকে এক মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হারিয়েছেন। স্ত্রীর অকালপ্রয়াণের শোক তিনি হৃদয়ে বহন করলেও, সেই বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তর করে দেশের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
গতকাল ২৯শে অক্টোবর ছিল ওসমান জাহাঙ্গীরের ৬০তম জন্মদিন। নবীন-প্রবীণদের মিলনমেলায় এই দিনে আমরা তাকে নতুনভাবে ভাবলাম, উপলব্ধি করলাম। কেক কাটার আনুষ্ঠানিকতার পর ওসমান জাহাঙ্গীর রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ক এক সংলাপ আয়োজন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন খ্যাতিমান কবি মাহমুদুল হাসান নিজামী, এবং আমি—তার দীর্ঘ পথচলার একজন সহযাত্রী। প্রিয় লেখক, সাংবাদিক ও গবেষকগণ সেই আলোচনাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন।
রাষ্ট্রের কাঠামো ও ক্ষমতার প্রবাহ, মানুষের জন্মগত অধিকার, রাষ্ট্র কর্তৃক কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ—এসবই ছিল তার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য। রাষ্ট্রদর্শনের আলোকে সমসাময়িক সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধানের পথ বাতলে দিয়ে তিনি আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শেখালেন। সাগর-চর-পাহাড়ের রূঢ় প্রকৃতি যেমন তাকে থামাতে পারেনি, তেমনি রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক প্রতিকূলতাও তাকে দমাতে পারবে না—এই বিশ্বাস আমাদের মনে প্রোথিত।
এ এক ব্যতিক্রমী জন্মদিন, যেখানে শুধুমাত্র বয়স নয়, চিন্তা ও আদর্শের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন আমাদের প্রিয় ওসমান জাহাঙ্গীর।
রাষ্ট্রদর্শন ও জীবনদর্শনের সন্ধিক্ষণে
রাষ্ট্রের এখনো কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। তবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, কার্যকর সরকার, সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—এই পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বর্তমান যুগে চিহ্নিত হয়। মানবতার সুরক্ষা ও উত্তম জীবনযাপনই রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য।
প্রাচীন গ্রীসের ‘সিটি-স্টেট’ বা নগররাষ্ট্রগুলোকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা পৃথিবীর আদি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে থাকেন। সেগুলো ছিল ছোট ছোট স্বাধীন জনসমষ্টি, যেখানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠত। একে আদি গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের একটি বড় দুর্বলতা ছিল—”অধিক সন্ন্যাসী গাজন নষ্ট” কথাটির বাস্তব প্রতিফলন। যেমন, এথেন্সে ৫২৫ জনের জুরি বোর্ড সক্রেটিসের মতো এক মহান চিন্তাবিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যা তার শিষ্য প্লেটোকে গভীরভাবে আঘাত করে। তিনি এই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে অভিজাততন্ত্রের দর্শন রচনা করেন।
প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল অভিজাততন্ত্র নয়, বরং মধ্যপন্থার পক্ষে ছিলেন। তার মতে, রাষ্ট্রে ভিন্নমতের সহাবস্থান থাকা জরুরি; অন্যথায় তা পরিবার বা ব্যক্তির শাসনে পরিণত হবে। যদিও প্লেটো ও এরিস্টটলের মধ্যে চিন্তার ভিন্নতা ছিল, তবুও দুজনই রাষ্ট্রকে মানুষের প্রয়োজনে গঠিত একটি কাঠামো হিসেবে দেখেছেন।
প্রাচীন গণতন্ত্র ছিল অনেক দিক থেকেই সীমাবদ্ধ। এথেন্সের নাগরিকদের একটি বড় অংশ ছিল দাস ও বিদেশি; নারীদের ছিল না কোনো ভোটাধিকার। আধুনিক গণতন্ত্র তার চেয়ে অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হলেও তাতে নতুন ধরনের অসন্তোষ ও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্রে ভোটার যেন মরুভূমির বালুকণার মতো—নির্বাচনের সময় তার অস্তিত্ব স্মরণ করা হয়, এরপর সে আবার বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়।
গণতন্ত্রের অন্যতম সমস্যা হলো—সেই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয় সাধারণ জনগণই। তারা প্রতিনিয়ত শোষণ, দুর্নীতি ও দলীয় রাজনীতির বলি হয়। ফলে বহু রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র আজ ব্যর্থ ও অকার্যকর এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে রাষ্ট্র-নির্মিত ভুয়া আশা, ভোটের নামে প্রতারণা এবং শাসকের একচ্ছত্র আধিপত্য।
জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র বনাম অহী-নির্দেশিত রাষ্ট্র
প্লেটো থেকে ফাগুয়ে পর্যন্ত বহু চিন্তাবিদ গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। কেউ বলেছেন ‘মূর্খের শাসন’, কেউ বলেছেন ‘শয়তানের শাসন’। মূল সমস্যা হলো, চরিত্রবান ও আদর্শবান ব্যক্তিদের অনুপস্থিতি। শাসনব্যবস্থায় তারা নেই—কারণ তারা কখনো ভোট চাইতে দুয়ারে দুয়ারে যান না।
গণতন্ত্রের দলীয় কাঠামো প্রশাসন, বিচার, শিক্ষা, এমনকি সমাজের নৈতিক ভিত্তিকেও দলীয়করণে আক্রান্ত করে। এক সময় রাজনীতির নামে গড়ে ওঠে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির জাল। শাসকের শোষণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রাষ্ট্রকে মানুষের কল্যাণ থেকে বিচ্যুত করে তোলে। ফলে অনেক রাষ্ট্রই এখন ‘ব্যর্থ’ বা ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ পরিভাষায় যুক্ত হয়েছে।
নবীপ্রবর্তিত রাষ্ট্রদর্শন : তাওহীদ ও তাকওয়ার শাসন
এই বিপরীতে নবীগণ প্রদর্শন করেছেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন রাষ্ট্রদর্শন—যার ভিত্তি তাওহীদ, তাকওয়া এবং অহী। সেখানে সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ। নবী ছিলেন সেই শাসনের প্রধান নির্বাহী, যিনি আল্লাহর বিধান অনুসারে সমাজ পরিচালনা করতেন। সেখানে হালাল-হারাম নির্ধারণে মানুষের কোনো হাত নেই; মতামত বা ভোটের প্রয়োজন কেবল বাস্তবায়নের পদ্ধতিতে।
এই ব্যবস্থায় সব মানুষ সমান—দাস-মালিক, ধনী-গরিব, শাসক-শাসিতের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই। মানুষ আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে জান্নাত লাভের আশায় নেক কাজ করে। এখানে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা নেই; আছে ন্যায়বিচার ও সাম্য।
এই হচ্ছে খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন—যার আদর্শিক ভিত্তি রচিত হয়েছে মদীনার রাষ্ট্রে। যেখানে মানুষ ছিল ভাই ভাই, রাষ্ট্র ছিল আল্লাহর আইনভিত্তিক, নেতৃত্ব ছিল তাকওয়াশীল ও নিরপেক্ষ।
আমরা কি সেই রাষ্ট্রদর্শনের পথে ফিরে যেতে পারি না?
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন—আমীন।